ডিজিটাল এই যুগে আমরা প্রায় সবাই ইংরেজি ক্যালেন্ডারের উপর নির্ভরশীল। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই চলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কিন্তু এর মাঝেও এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা আমাদের বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জির কাছে। আর তা হলো বাংলা ক্যালেন্ডার। "আজকের বাংলা তারিখ কত?"—এই প্রশ্নটি শুধু একটি তারিখ জানার কৌতূহল নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি প্রয়াস।
এই পেজটি আপনাকে কেবল আজকের বাংলা তারিখ নির্ভুলভাবে জানাতেই সাহায্য করবে না, বরং বাংলা ক্যালেন্ডারের পেছনের সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কেও বিস্তারিত ধারণা দেবে।
বাংলা ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটি কেবল একটি দিন গণনার পদ্ধতি নয়, এর সাথে মিশে আছে আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য, কৃষি, উৎসব এবং সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান। "বারো মাসে তেরো পার্বণ"—এই প্রবাদটিই প্রমাণ করে যে বাঙালির উৎসবমুখর জীবনের প্রতিটি ধাপ বাংলা ক্যালেন্ডারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ফসলের মাঠে বীজ বোনা থেকে শুরু করে নবান্নের উৎসব, বৈশাখী মেলা থেকে শুরু করে পূজাপার্বণ—সবকিছুর সাথেই বাংলা তারিখের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক।
বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎস নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত থাকলেও দুটি তত্ত্ব সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
১. রাজা শশাঙ্কের অবদান: অনেক ঐতিহাসিকের মতে, প্রাচীন বাংলার গৌড় রাজ্যের প্রভাবশালী রাজা শশাঙ্ক আনুমানিক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে "বঙ্গাব্দ" গণনা শুরু করেন। মূলত কৃষিকাজ এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই এই সৌর পঞ্জিকার প্রচলন করা হয়।
২. মুঘল সম্রাট আকবরের প্রচলন: সবচেয়ে জনপ্রিয় মত অনুসারে, মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য একটি নতুন ক্যালেন্ডার চালু করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই সময়ে মুঘল সাম্রাজ্যে হিজরি ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো, যা ছিল চন্দ্রনির্ভর। কিন্তু কৃষিকাজ এবং ফসল তোলা সম্পূর্ণ সৌর বছরের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় চান্দ্রবর্ষের সাথে এর কোনো মিল ছিল না। ফলে কৃষকদের অসময়ে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হতো। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সম্রাট আকবর তাঁর রাজজ্যোতিষী ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে একটি নতুন ও বিজ্ঞানসম্মত ক্যালেন্ডার তৈরির নির্দেশ দেন। সিরাজি সৌর বছর এবং হিজরি সনকে ভিত্তি করে একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করেন, যা "তারিখ-ই-ইলাহি" নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এটিই "বঙ্গাব্দ" বা বাংলা সন হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বাংলা ক্যালেন্ডার একটি সৌর বর্ষপঞ্জি, যা ৩৬৫ দিনে এক বছর গণনা করে। এর গঠন অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত এবং আমাদের দেশের ষড়ঋতুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মাস: বাংলা বছরে মোট ১২টি মাস রয়েছে। মাসগুলোর নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্রের নামানুসারে। মাসগুলো হলো:
বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র।
ঋতু: প্রতি দুই মাস নিয়ে একটি ঋতু গঠিত হয়। বাংলা বছরে মোট ৬টি ঋতু রয়েছে, যা বাঙালির জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলে। ঋতুগুলো হলো:
গ্রীষ্ম (বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ)
বর্ষা (আষাঢ়, শ্রাবণ)
শরৎ (ভাদ্র, আশ্বিন)
হেমন্ত (কার্তিক, অগ্রহায়ণ)
শীত (পৌষ, মাঘ)
বসন্ত (ফাল্গুন, চৈত্র)
সময়ের সাথে সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সংশোধিত ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে তৈরি করা হয়েছে। এই সংশোধিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী:
বছরের প্রথম ৬ মাস (বৈশাখ থেকে আশ্বিন) ৩১ দিনে গণনা করা হয়।
শেষ ৬ মাস (কার্তিক থেকে চৈত্র) ৩০ দিনে গণনা করা হয়।
ইংরেজি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনা করা হয়, যাতে বাংলা ও ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যাপক ব্যবহার সত্ত্বেও, আজও বাঙালির জীবনে বাংলা তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম।
উৎসব ও অনুষ্ঠান: দুর্গাপূজা, পহেলা ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রান্তি, নবান্ন উৎসবের মতো সকল সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব বাংলা তারিখ অনুযায়ী পালন করা হয়।
জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক মনীষীর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বাংলা তারিখ অনুযায়ী উদযাপন করা হয়।
কৃষিকাজ: গ্রামের কৃষকেরা আজও বাংলা ক্যালেন্ডার দেখেই জমিতে বীজ বপন করেন, ফসল কাটেন এবং ঋতু পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণ করেন।
ঐতিহ্যের সাথে সংযোগ: আজকের বাংলা তারিখ জানাটা কেবল একটি তথ্য নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে নিজেদের সংযুক্ত রাখার একটি মাধ্যম।
বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ, বাঙালির সর্বজনীন এবং অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই দিনটি বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালন করে। নতুন পোশাক পরা, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া, পান্তা-ইলিশ খাওয়া এবং ব্যবসায়ীদের হালখাতা খোলা—এই সবকিছুই পহেলা বৈশাখের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনটি পুরনো বছরের সকল জীর্ণতাকে মুছে ফেলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।
আজকের বাংলা তারিখ শুধু একটি ক্যালেন্ডারের পাতা নয়, এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের একটি অংশ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের সমৃদ্ধ অতীত, ঋতুবৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক উৎসবের কথা। আমাদের এই ওয়েবসাইটটি আপনাকে প্রতিদিনের নির্ভুল বাংলা তারিখ, মাস ও ঋতুর তথ্য দিয়ে আপনার ঐতিহ্যকে জানতে ও মনে রাখতে সাহায্য করবে। তাই প্রতিদিন আজকের বাংলা তারিখ জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।